এই ক্রোয়েশিয়াকে মনে রাখবে দুনিয়া। ৪-২ গোলে উত্তেজনাকর ফাইনাল জিতে দ্বিতীয়াবেরর মতো বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছে ফ্রান্স। তাতে কি? হারলেও সারা বিশ্বের মন জয় করে নিয়েছে বলকান অঞ্চলের যুদ্ধবিধ্বস্ত ছোট্র দেশ ক্রোয়েশিয়া।
ভাগ্য সহায় ছিল না ক্রোয়েশিয়ার। দুটি গোল খেতে হয়েছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে। ওই দুটি গোলই ব্যবধান গড়ে দেয়, কাল হয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত। তবে ফাইনাল হয়েছে ফাইনালের মতো। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ, দুর্দান্ত গতিময় ফুটবল। ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া দুর্দান্ত ফাইনালটা অনেক দিন মনে থাকবে সবার।
বল পজিশন ৬৬ শতাংশ ছিল ক্রোয়েশিয়ার দখলে। মাত্র ৩৪ ভাগ বল পজিশন নিয়েও ফাইনাল জিতে নেয় ফ্রান্স। ক্রোয়েশিয়া মোট শট নিয়েছে যেখানে ১৪টি, ফ্রান্স সেখানে তার অর্ধেক, ৭টি। তবে ফ্রান্সের শট ছিল লক্ষ্যভেদি। আর এখানেই পিছিয়ে যায় ক্রোয়েশিয়া। ফ্রান্সের ৭ শটের মধ্যে ৬টি শটই অন টার্গেটে ছিল, অন্যদিকে ক্রোশিয়ার ১৪ শটের মধ্যে মাত্র অন টার্গেটে ছিল ৪টি। ক্রোয়েশিয়া কর্নার লাভ করে ৬টি, সেখানে ফ্রান্স মাত্র ২টি। কিন্তু ফুটবল যে গোলের খেলা। কখনও ভাগ্যটা সহায় হতে হয়।
মস্কোর লিঝনিকি স্টেডিয়ামে ফ্রান্স-ক্রোয়োশিয়া ফাইনাল দারুণ জমে ওঠে শুরু থেকেই। বল পজিশনে, আক্রমণে ক্রোয়েশিয়া এগিয়ে থাকলেও দুর্ভাগ্যবশত ২-১ গোলে পিছিয়ে থেকে প্রথমার্ধের খেলা শেষ করতে হয় তাদের।
শুরুটা ফ্রান্সের চেয়ে কিন্তু ঢের ভালো ছিল ক্রোয়েশিয়ার। পোস্টে ভালো কোনো শট নিতে না পারলেও ফরাসি রক্ষভাগের উপর বেশ চাপ সৃষ্টি করেছিল ক্রোটরা। খেলায় স্পষ্ট প্রাধান্য ছিল তাদেরই। কিন্তু ১৮তম মিনিটে অনেকটা রেফারির কৃপায় বিপজ্জনক স্থানে ফ্রি কিক পেয়ে যায় ফ্রান্স।
ফ্রান্স আক্রমণে গিয়েছিল। গ্রিজম্যানের কাছ থেকে বল দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ব্রোজোভিচ। গ্রিজম্যানের পায়ে সামান্য ধাক্কা লেগেছিল বটে কিন্তু ক্যামেয়ার দেখা গেছে, মোটেও ইচ্ছা করে তা করেননি ব্রোজোভিচ। কিন্তু আর্জেন্টাইন রেফারির কৃপায় বিপজ্জনক স্থানে ফ্রিকিক পেয়ে যায় ফ্রান্স। শট নিয়েছিলেন গ্রিজম্যান নিজে। দারুণ শট ছিল। সেই শট বিপদমুক্ত করতে গিয়ে মাথার এক পাশে লেগে নিজেদের জালেই বল জড়িয়ে দেন মানজুকিচ।বিশ্বকাপের ফাইনালে এটাই প্রথম আত্মঘাতি গোলের নজির। নিজেকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মানজুকিচ।
কিন্তু ক্রোটরা দমে যাওয়ার পাত্র নন। নক আউট পর্বে আগের তিন ম্যাচে প্রথমে গোলে খেয়ে ঘুরে দাঁড়ান তারা। এ দিনও তাই হলো। ২৮তম মিনিটে নাটকীয়ভাবে সমতায় ফিরে ক্রোয়েশিয়া।ডি-বক্সের ভেতর থেকে দুর্দান্ত শটে গোল করেন ইভান পেরিসিচ। হাফ ছেড়ে বাঁচে ক্রোয়েশিয়া।
১-১ সমতায় আসার খেলা দারুণ জমে ওঠে। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে চেষ্টায় ঘাম ঝরাতে থাকে দুই দল। কিন্তু এরই মধ্যে আরেকটি দুর্ভাগ্য সঙ্গী হয় ক্রোয়েশিয়ার। ৩৮তম মিনিটে পেনাল্টি পেয়ে যায় ফ্রান্স। কিন্তু কোনো ফাউলের জন্য নয়। নিতান্ত দুর্ভাগ্যে। গ্রিজম্যানের কর্নার হেডে সেভ করতে গিয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বল আলতো হাতে লেগে যায় পারিসিচের । সিদ্ধান্ত নিতে ভিডিও রিপ্লের সাহায্য নেন রেফারি। ক্রোয়েশিয়াকে হতাশ করে আসে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত। পেনাল্টি শট থেকে গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে নেন গ্রিসম্যান।
আবারও পিছিয়ে পড়ে ক্রোয়েশিয়া। এবং এবারও গোল পরিশোধের দারুণ চেষ্টা একের পর এক। প্রথমার্ধের শেষ দিকে গোটা দুয়েক ত্বরিৎ আক্রমণ শানায় ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু ২-১ গোলে পিছিয়ে থেকেই প্রথম ৪৫ মিনিটের খেলা শেষ করতে হয়।
গত তিন ম্যাচে দেখে গেছে, সময় যতো গড়িয়েছে ততই গতি বেড়েছে ক্রোয়েশিয়ার। এদিনও দ্বিতীয়ার্ধে শুরুতে সেটাই দেখাচ্ছিলেন ক্রোটরা। ৪৯তম মিনিচে ক্রোয়েশিয়ার দারুণ একটি আক্রমণ কর্নারের বিনিময়ে বিপদমুক্ত করেন ফরাসি গোল কিপার। কিন্তু ৫৯তম মিনিটে ক্রোয়েশিয়াকে হতাশায় ভাসিয়ে ৩-১ গোলে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। ডি বক্সের আশে পাশে বল দেওয়া নেওয়ার এক পর্যায়ে বাঁ পায়ের দুর্দান্ত শটে পোগবা বল জড়িয়ে দেন জালে।
এর ৬ মিনিট পর ব্যবধান আরও বাড়িয়ে নেয় ফ্রান্স। এবার গোলদাতা এমবাপে। ২৫ গজ দূর থেকে দুর্দান্ত শটে গোলটি করেন ১৯ বয়র বয়সী স্ট্রাইকার। ফ্রান্স ৪-১ গোলে এগিয়ে। মানে অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাশিয়া বিশ্বকাপ অনেকটাই নিশ্চিত করেছে ফেলেছে ফ্রান্স।
এই অবস্থায় ৬৯ মিনিটে নাটকীয়ভাবে গোল করে ব্যবধান কামান সেই মানজুকিচ, যিনি প্রথমেই আত্মঘাতি গোলে পিছিয়ে দিয়েছিলেন দলকে। এ গোলের মাধ্যমে যেন পাপমোচন করলেন মানজুকিচ। গোলটার জন্য অবশ্য দায়ি ছিলেন ফরাসি গোল কিপার। পুরো বিশ্বকাপ অসাধারণ খেলেছেন চারবারের নিচে। কিন্তু ফাইনালে এসে বোকামির দন্ড দেন লরিস। উমতিতির কাছে বল ছিল। সেখানে দৌড়ে যান মানজুকিচ। তখন উমতিতে বল দেন পেছনে, গোলকিপার লরিসকে। দ্রুত দৌড়ে যান মানজুকিচ। গোল লাইনে সামনে মানজুকিচকে কাটাতে গিয়ে বল বেদখল হয়ে যায়। সুযোগ সন্ধানী মানজুকিচ সুযোগ নিতে মোটেও ভুল করেননি। ৪-২। কিন্তু এরপরও নাটকীয় কিছু করতে হতো ক্রোয়েশিয়াকে, যেটা সম্ভব হয়নি।
বারবার আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে ক্রোয়েশিয়া। সুযোগও পেয়েছিল বেশ কয়েকটা। কিন্তু না, গোলের দেখা আর পাওয়া যায়নি। বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নও পুরণ হয়নি তাদের। ১৯৯৮ সালের পর বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছে ফ্রান্স।